ইসলাম ডেস্ক: বিশাল সমুদ্র, এর মাঝে একটি মাজার। বিস্ময়কর শোনালেও বাস্তবেই অস্তিত্ব রয়েছে বিস্ময়কর এই স্থানের। পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর এই মাজারটির নাম হাজী আলি শাহ- এর মাজার। আরব সাগরের উপকূল থেকে ৫০০ মিটার দূরে একটি ছোট ক্ষুদ্র দ্বীপে অবস্থিত। মাজারটি সম্পর্কে বা মাজারটির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে আগে জানতে হবে যার নামে এই মাজার তার ইতিহাস। সৈয়দ পীর হাজী আলি শাহ বুখারি ছিলেন একজন সুফী পীর এবং বর্তমান উজবেকিস্তানের (তৎকালীন নাম বুখারা) একজন ধনী বণিক। ইলমের (বিশ্বাসের জ্ঞান) মাধ্যমে তিনি অনেক অলৌকিক কাজ করতেন।
তিনি বিশ্বভ্রমন করেন এবং অবশেষে ভারতের মুম্বাইয়ে এসে থেকে যান। ভারতে ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন ভ্রমনকারী এবং সুফীগণ মুম্বাইয়ের (তৎকালীন ওয়ার্লি) স্থানীয়দের মধ্যে এসে থাকতে শুরু করেন এবং ইসলামের বানী প্রচার করতে থাকেন। তিনিও তখন সেখানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত ‘হাজী আলী দরগাহ’ এই পীরের স্মরণেই নির্মাণ করা হয়েছে।
হাজী আলী শাহ মুম্বাইয়ে আসার পূর্বে উজবেকিস্তানে বাণিজ্য করতেন। বলা হয় যে, উজবেকিস্তানে থাকাকালীন একদিন তিনি নামাজ পরে ফেরার সময় রাস্তায় এক মহিলাকে দেখে থেমে যান। মহিলাটি কাঁদছিলেন দেখে তিনি মহিলার কাছে গিয়ে তার কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। মহিলাটি উত্তর দিলেন যে, সে তেল কিনে বাড়ি ফেরার সময় তেলের বোতলটি পথে পড়ে গিয়েছে এবং বোতলের তেল মাটি শুষে নিয়েছে। তার স্বামী যদি একথা জানতে পারে তাহলে তাকে মারবে। মহিলাটির কান্না দেখে আলী শাহের খারাপ লাগে এবং তিনি তার একটি আঙ্গুল মাটির ভিতরে প্রবেশ করায় ফলে মাটি ভেদ করে তেলের ফোয়ারা উঠে আসে মহিলাটি সেখান থেকে তার তেলের বোতলটি পুনরায় ভরে খুশিমনে বাড়ি চলে যায়।
কিন্তু এরপর থেকে তার খারাপ লাগা শুরু হয় যদিও সে মহিলাটির উপকার করেছে কিন্তু তার এটা ভেবে খারাপ লাগে যে তিনি মাটি খুড়ে মাটিকে আঘাত করেছেন। এরপর থেকে তিনি রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তিনি তার মায়ের অনুমতি নিয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে ভারত সফর করেন এবং অবশেষে মুম্বাইয়ের সমুদ্রতীর ওয়ার্লি অথবা বর্তমানে তার সমাধির বিপরীত কোনো জায়গায় এসে পৌছান।
এক সময়ে তার ভাই তাদের নিজ দেশে ফিরে যায়, কিন্তু আলি শাহ সেখানেই থেকে যায় এবং ভাইয়ের কাছে তার মায়ের জন্য একটি চিঠি লিখে দেয় যে, তার শরীর ভালো না এবং সে মুম্বাইতে থেকে ইসলাম প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মা যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের কাছে ইসলামের বাণী প্রচার করে গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার ভক্তদের নির্দেশ দিয়ে যান যে, মৃত্যুর পর তাকে যেন কোন নির্দিষ্ট স্থান বা কবরস্থানে সমাহিত না করে কাফন পড়িয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয় যাতে তাকে সেই মানুষরাই দাফন করতে পারে যারা তাকে খুঁজে পাবে।
তিনি হজ্ব পালন করতে পবিত্র মক্কা নগরী গিয়েছিলেন। মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার পূর্বে তিনি তার সব সম্পদ বিলিয়ে দেন। কিন্তু হজ্ব পালন করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। তার ভক্তরা তার দেয়া আদেশ পালন করে এবং তার কাফন সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে তার কাফন মুম্বাইয়ের ওয়ার্লি সমুদ্রের মাঝে পৌঁছে। পরবর্তীতে সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয় ও দরগাহ শরীফ নির্মিত হয়। তার দরগাহর অট্টালিকাটি অসাধারন ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত। ক্ষুদ্রদ্বীপটি মহালক্ষী শহরের সঙ্গে একটি সংকীর্ণ বাঁধ দ্বারা যুক্ত যা লম্বায় প্রায় এক কিলোমিটার।
দরগাহে প্রবেশ করতে পারাটা অনেকটা জোয়ারের ওপর নির্ভরশীল। রেলিং না থাকার কারণে জোয়ারের সময় যখন বাঁধটি যখন ডুবে যায় তখন দরগাহ প্রবেশযোগ্য থাকেনা। তাই শুধুমাত্র কম জোয়ারের সময় দরগাহতে যেতে দেয়া হয়। দরগাহটি ভ্রমণকারী এবং হাজী শাহের ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। মুসলিম ধর্ম ব্যতিত অন্য সকল ধর্মের মানুষদের জন্যেও জায়গাটি উন্মুক্ত। মানুষ সেখানে বিভিন্ন মানত নিয়ে যায় এবং তাদের মতে ওখানে গিয়ে প্রার্থনা করলে সকল ইচ্ছা পূরণ হয়।
দরগাহটি জুড়ে বড় একটি সাদা মার্বেল পাথর রয়েছে। মসজিদের ভিতরের সমাধিটি একটি লাল বুটিদার এবং সবুজ চাদর দ্বারা আবৃত। মূল হলঘরটিতে মার্বেল স্তম্ভগুলো শৈল্পিক আয়নার কাজের সঙ্গে বিভিন্ন রঙিন পাথরে অলংকৃত যেখানে আরবিতে আল্লাহর ৯৯টি নামের বানান লেখা। প্রায় ছয়শত বছর পুরোনো এই দরগাহটি প্রতিনিয়ত লবণাক্ত বাতাস এবং সপ্তাহে প্রায় ৮০ হাজার দর্শনার্থীদের কারণে ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে।
১৯৬০ ও ১৯৪০ সালে দরগাহর ব্যাপক সংস্কার করা হয়। এর সর্বশেষ সংস্কার করা হয় ২০০৮ সালের অক্টোবরে। দরগাহটি শীঘ্রই প্রথম এবং দ্বিতীয় মানের সাদা মার্বেল দ্বারা সজ্জিত করা হবে যা রাজস্থানের মাকরানা থেকে আনা হবে যেখান থেকে তাজমহলের মার্বেল আনা হয়েছিল। প্রতি সন্ধ্যায় দরগাহ আলোক সজ্জায় এমনভাবে সজ্জিত করা হয় যা অন্ধকার সমুদ্রের মাঝে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।
প্রতিবছর মাজারটিতে হাজী শাহের মৃত্যুবার্ষিকী, ঈদুল-ফিতর, ঈদুল-আযহা পালন করা হয়। এছাড়া প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় কাওয়ালিদের আসর বসে যা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। দরগাহটিতে প্রথমে নারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। বলিউডের ‘ফিজা’ সিনেমার ‘পিয়া হাজী আলী’ গানটির শুটিং এখানে করা হয়। দরগাহটির সবথেকে চমকপ্রদ ব্যাপার হল যেকোনো দূর্যোগের মোকাবিলা করে এর টিকে থাকা। সমুদ্রের মাঝে থাকা সত্ত্বেও সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এই দরগাহর কোনো ক্ষতি করতে পারেনা। এমনকি এক ফোটা পানিও দরগাহর মধ্যে প্রবেশ করেনা।
১৯৪৯ সালে যে তুফানে মুম্বাইর অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে সেটাও দরগাহর ওপর আঘাত হানেনি। ২০০৫ সালের ভারি বন্যাতে যখন মুম্বাই শহর ডুবে গিয়েছিল তখনও দরগাহ এর কোনো ক্ষতি হয়নি। এতসব ভয়ংকর প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউও দরগাহটির কোনো ক্ষতি করতে না পারার পিছনের কারণ জানতে স্বাভাবিকভাবে সবাই উৎসুক থাকে। তবে বিজ্ঞানীরা অনেক চেস্টার পরেও এর কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি। মুম্বাইয়ের হাজী আলী দরগাহ সেই জায়গাগুলোর মধ্যে একটি যা আপনাকে প্রশান্তি দিবে। সর্বোপরি, আপনি আরব সাগরের নীল জলের মাঝে মহিমান্বিত্ব একটি সমাধি দেখতে পাবেন। (তথ্যসূত্র অনলাইন থেকে সংগৃহীত।)